যে জন্য জাপানকে সূর্য উঠার দেশ বলায়

The land of the rising sun

ছেলেমেয়ে ও দুই দৈত্যের গল্প।

আজ থেকে কতো বছর আগে এ ঘটনাটি ঘটেছিলো, কেউ তা জানে না। তবে তা যে প্রায় কয়েক হাজার বছর আগের ঘটনা, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। যে সময়ের ঘটনা সে সময় এ পৃথিবী দৈত্য-দানবে ভরা ছিলো। পাহাড়ের গুহায়, মেঘের আড়ালে আর গভীর বনে বাস করতো ওরা। আর মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য সুযোগ খুঁজতো।
জাপানো নিপ্পো নামে একটি সুন্দর দ্বীপ রয়েছে। সেই দ্বীপে শুধু জেলেরা বাস করতো। রোজ সকালে জেলে আর জেলেনীরা সমূদ্রে মাছ ধরতে যেতো। তাদের ছোট ছোট ফুটফুটে ছেলেমেয়েরা বাড়িতে বসে খেলা করতো। কেউ কেউ গ্রামের পাশের বনে ফুল কুড়িয়ে আনতে যেতো। বনের গাছ থেকে ফল পেড়ে খেতো। এভাবেই সুখে-শান্তিতে নিপ্পোবাসীদের দিন কাটছিলো।

একদিন জেলে আর জেলেনীরা সমূদ্রে গেছে মাছ ধরতে। ছেলেমেয়েরা নিজেদের ইচ্ছে মতো খেলাধুলা করছে। এমন সময় আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে, সারা দ্বীপ তোলপাড় করে এক দৈত্য এসে হাজির হলো। এসে যখন দেখতে পেলো নিপ্পো দ্বীপে কোনো জেলে-জেলেনী নেই, তখন সে বুঝতে পারলো আসল ঘটনাটা কি। দৈত্য তখন সমূদ্রে ছুটে গেলো। তারপর শো শো শব্দ করে তুমুল ছড় তুললো। বাতাসের দাপটে বড়ো বড়ো ঢেউ উঠলো। আর ঢেউয়ের ধাক্কায় জেলেদের সব নৌকা ডুবে গেলো। জেলে-জেলেনীরা কিছুক্ষণ বাঁচার জন্য চেষ্টা করে ধীরে ধীরে সমুদ্রের গভীরে ডুবে গেলো।
জেলে-জেলেনীদের মেরেও কিন্তু রাগী দৈত্যটার মন শান্ত হলো না। সে এবার নিপ্পো দ্বীপের দিকে ছুটে চললো।
দৈত্যরা তো পাহাড়ের মতো উঁচু হয়। তাই দূর থেকেই ওদের দেখা যায়। নিপ্পো দ্বীপের ছেলেমেয়েরাও দূর থেকে দৈত্যটাকে দেখতে পেলো। ওরা দেখলো, সমুদ্রের ওপর ভেসে ভেসে রাগী দৈত্যটা নিপ্পোর দিকে আসছে। একবার দ্বীপে এসে হাজির হলে সে সবাইকে মেরে ফেলবে, এটুকু বুঝতে পেরেছিলো ছেলেমেয়েরা। ওরা তাই দ্রুত বড়ো বড়ো গাছে উঠে পাতার আড়ালে লুকিয়ে রইলো।
এ ঘটনার কয়েক মিনিট পরই হাঁপাতে হাঁপাতে রাগী দৈত্য এসে হাজির হলো। সে নিপ্পো দ্বীপে আতিপাতি করে ছেলেমেয়েদের খুঁজে বেড়ালো। কিন্তু কোথাও কাউকে দেখতে পেলো না।
দৈত্য অবাক হলো এ ঘটানায়। মনে মনে সে বললো, কিছুক্ষণ আগে আমি যখন জেলেদের খোঁজে নিপ্পোতে এসেছিলাম,তখন তো ছেলেমেয়েরা আপন মনে খেলছিলো। এখন তো দেখছি একটা ছেলেও নেই মেয়েও নেই। ওরা গেলো কোথায়? নিশ্চয়ই কোথাও লুকিয়ে রয়েছে। কিন্তু কোথায় লুকোতে পারে?
এ কথা ভেবে সেই রাগী দৈত্যের এতো রাগ হলো যে, সে বিকট একটা চিৎকার দিয়ে পা ঝাড়া দিলো। প্রচন্ড জোরে বাতাসে ফুঁ দিলো। সঙ্গে সঙ্গে দ্বীপের ছোট ছোট গাছগুলো ভেঙে পড়লো। মাঝারি আকৃতির গাছের পাতা টুপটুপ করে ঝরে পড়লো। কিন্তু যে সব পাতার আড়লে জেলেদের ছেরেমেয়েরা লুকিয়ে ছিলো, সে সব পাতা গাছের সঙ্গেই ঝুলে রইলো। তাই দৈত্যটা বুঝতে পারলো না ছেলেমেয়েরা কোথায় আছে।
দৈত্য জেলে আর জেরেনীদের মারার সময় ভেবেছিলো বুড়োগুলোকে মেরে ছোট ছোট বাচ্চাদের টপাটপ গিলে খাবে। কিন্তু তা তো সে পারেনি। তাই তার ভীষণ খিদে লাপলো। সে তখন চিৎকার করে বললো, তোদের জন্য আমি না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছি। এ শোধ আমি তুলবো। এখন খেতে যাচ্ছি। তবে আবার ফিরে আসবো।
এ দৈত্যটার নাম ছিলো ঝড়ের দৈত্য। সে শুধু প্রচন্ড বেগে ঝড় তুলতে পারতো। অন্য কিছু করার ক্ষমতা ছিলো না। তাই সে তার বন্ধু শীতের দৈত্যের কাছে গেলো। তাকে গিয়ে বললো, বন্ধু! একটা সমস্যায় পড়ে তোমার কাছে এসেছি। আমাকে একটু বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সাহয্য করো।
শীতের দৈত্য বললো, আগে সমস্যার কথাটা বলো। ভেবে দেখি আমি তোমার কোনো উপকারে লাগতে পারবো কিনা।
ঝড়ের দৈত্য তখন সব কতা খুলে বললো। সে কথা শুনে শীদের দৈত্য বললো, আমারও ধারণা নিপ্পোর ছেলেমেয়েরা কোনো জুতসই জায়গায় লুকিয়ে রায়েছে। আমি প্রচন্ড শীত ছড়িয়ে দেবো। সেই শীতের দাপটে ওদের আশ্রয় থেকে টেনে বের করবো। চলো, এক্ষনি আমরা নিপ্পো দ্বীপে যাই।
দৈত্যরা তো ঝড়ের গতিতে চলে। তাই সিদ্ধান্ত নেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড়ের আর শীতের দৈত্য নিপ্পোতে এসে হাজির হলো। তবে তাদের আসতে দেখেই ছেলেমেয়েরা পাতার আড়ালে লুকিয়ে পড়েছিলো। তাই এবারও কাউকে দেখতে পেলো না।
এমন হলে তো রাগ হবারই কথা। শীতের দৈত্য আর ঝড়ের দৈত্যেরও খুব রাগ হলো। ওরা একজন তখন সারা নিপ্পো জুড়ে প্রচন্ড ঝড় তুললো। অন্যজন তীব্র শীত বইয়ে দিলো। শীতের জন্যে ঝুরঝুর করে তুষার পড়তে লাগলো। আর ঝড়ের তোড়ে গাছ থেকে পাতারা ঝরে পড়তে লাগলো। পাতার সঙ্গে সঙ্গে জেলেদের ছেলেমেয়েরাও নিচে পড়লো। কিন্তু দৈত্যদের চোখে পড়ার আগেই তুষার আর পাতার আড়ালে আড়ালে লুকিয়ে ওরা এক বড়ো গুহার ভেতর লুকিয়ে পড়লো। তারপর বিশাল একটা পাথর টেনে গুহার মুখ আটকে দিলো। শীত আর ঝড়ের দৈত্যরা ছেলেমেয়েদের খুঁজে না পেয়ে মনের দুঃখে চিরদিনের জন্য সেই দ্বীপ ছেড়ে চলে গেলো।
কিন্তু সমস্যা হলো, দৈত্যরা যে চলে গেছে, নিপ্পো দ্বীপের ছেলেমেয়েরা সে কথা জানতে পারেনি। তাই তারা পাথর সরিয়ে গুহা থেকে বেরিয়ে এলো না।
গুহার ভেতরে বসে অঝোরে ধারায় কাঁদতে লাগলো।
ছেরেমেয়েদের দুঃখে দ্বীপের গাছপালাও বিবর্ণ হয়ে গেলো। পাতারা ঝুরঝুর করে ঝরে পড়লো। লতারা ঢলে পড়লো। ফুল ফোটা বন্ধ হলো। বাড়িঘর সব ধুলোয় ঢেকে গেলো। আর আকাশ গাঢ় মেঘে ঢেকে গেলো। তাই দিনের বেলাও নিপ্পো দ্বীপে রাতের অন্ধকার নেমে এলো-দিন আর রাতের মাঝে কোনো পার্থক্যই রইলো না।
এভাবে অনেক দিন কেটে গেলো। নিপ্পো দ্বীপের গাছপালা সব মরে গেলো। পাখিরা দ্বীপ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেলো। এমন অবস্থা হলো যে, কোনো দিন যে, সেখানে কোনো মানুষজন বাস করতো, তার চিহ্নও ধীরে ধীরে মুছে গেলো।
দুই, একদিন নিপ্পো দ্বীপের ওপর দিয়ে আলোর দেবতা আর আলোর দেবী যাচ্ছিলেন। তারা যখন দেখলেন সারাটা নিপ্পো মরুভূমির মতো খাঁখাঁ করছে, তখন ভীষণ অবাক হলেন। কিন্তু তখন তো এ দ্বীপের এমন করুণ অবস্থা দেখেননি। হঠাৎ কি হয়েছে দ্বীপটার? আর দ্বীপের মানুষজনই বা গেছে কোথায়?
আলোর দেবী বললেন, আলোর দেবতা! চলো আমরা নিপ্পোতে নেমে দেখি। আমার তো মাথায়ই আসছে না, নিপ্পোর অবস্থা এমন হলো কেমনে করে? আর মানুষজনই বা গেলো কোথায়? চলো তো, ব্যাপারটা তদন্ত করে দেখি আসি।
আলোর দেবতা বললেন, হ্যাঁ চলো তাই করি।

তখন আলোর দেবতা আর আরোর দেবী দ্রুত নিপ্পোতে নেমে এলেন।  তারা পুরো ব্যাপারটা খোঁজখবর নিয়ে নিশ্চিত হরেন ঝড়ের তৈত্যের হাতে এই দ্বীপের এ অবস্থা হয়েছে। কোনো মানুষও বেঁচে নেই। কিন্তু আকাশে-বাতাসে খুব অস্পষ্ট কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। কে কাঁদছে এমন কারুণ স্বরে?

দেবতা আর দেবী খুঁজে খুঁজে সেই পাহাড়ের গুহাটাকে ঠিকই বের কারে ফেললেন। তারা কান পেতে শুনতে পেলেন ছেলেমেয়েদের কান্নার শব্দ। তখন আলোর দেবী ধাক্কা দিয়ে পাথরটাাকে গুহার মুখ থেকে সরিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে গুহার ভেতর থেকে পিলপিল করে ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে এলো। আলোর দেবতা বললেন, তোমরা গুহার ভেতরে ছিলে কোনো? নিপ্পো দ্বীপের গাছপালা এমনভাবে মরে গেছে কেনো? আর তোমাদের বাবা-মা-কোথায়?

ছেলেমেয়েরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বললো, ঝড় আর শীতের দৈত্যের কারণে আমাদের এ অবস্থা হয়েছে। ঝড়ের দৈত্য আমাদের বাবা-মাকে সমুদ্রে ডুবিয়ে মেরেছে। ‍ওদের ভয়ে আমরা বহু দিন ধরে গুহার ভেতরে লুকিয়ে রয়েছি। আলোর দেবতা আর আলোর দেবী বললেন, তোমাদের জীবনে যা ঘটেছে তা খুচ দুঃখজনক। তবে একটা সুখবর দিচ্ছি, দৈত্যরা আর এ দ্বীপে আসবে না। এখন আমরা তোমাদের জন্য কি করতে পারি, বলো।

ছেলেমেয়েরা বললো, তা আর সম্ভব নয়। কেউ একবার মারা গেলে তাদেরকে কখনো জীবিত করা যায় না।তোমরা অন্য কিছু চাও। বরো, কি চাই তোমাদের? ছেরেমেয়েরা বললো, তাহলে এ দ্বীপের গাছপালা থেকে যতো পাতা ঝরে পড়েছে, সবগুলোকে আবার গাছে গাছে লাগিয়ে দিন। দেবতারা বললেন, অন্য কিছু চাও। ঝরা পাতা শুকিয়ে মরে গেছে। মরা পাতাকে  বোঁটার সঙ্গে লাগানো সম্ভব নয়।

ছেরেমেয়েরা বললো, আমাদের সারাটা দ্বীপ মেঘে মেঘে ছেয়ে আছে। এ জন্য সূর্যের আরো এসে পৌছোয় না। সব সময় সারাটা দ্বীপ অন্ধকার হয়ে থাকে। আপনারা সূর্যের আলো আসার ব্যবস্থা করে দিন। এ কথা শুনে মেঘেরা বললো, তোমাদের মুখে হাসি ফুটলেই আমরা সরে যাবো। তখন সূর্যের আরো পাবে। দেবতা আর দেবী আবার জিজ্ঞেসা কররেন, সোনামণি ছেলেমেয়েরা, তোমরা কি পেলে খুশি হবে? ছেলেমেয়েরা বললো, আমরা গাছে গাছে নতুন ফুল দেখতে চাই। এমন ফুল, যা শুধু আমাদের জন্যই ফুটবে।

আরোর দেবী বললেন, তাই হবে। তোমাদের গাছগুলোতে আমরা নতুন ফুল ফুটিয়ে দিচ্ছি। আমাদের বিশ্বাস, এই ফুল তোমাদের আরো লাগবে। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে নিপ্পো দ্বীপের গাছে গাছে অপূর্ব সুন্দর চেরি ফুল ফুটলো। নতুন পাতা গজালো। মুহুর্তের মধ্যে সারাটা দ্বীপ প্রাণ ফিরে পেলো। ছোট ছোট বাচ্চারা খুশিতে হাততালি দিয়ে নেচে উঠলো।

সেই থেকে জাপানে গাছে গাছে রেরি ফুল ফুটছে। আর সবচেয়ে আগে সূর্ উঠছে-েএজন্যই জাপানকে সূর্ উঠার দেশ বলা হয়।
জাপানের রূপকথা
লেখক: এনায়েত রসুল