একটু চিন্তা করুন তো! একজন মানুষকে আপনি চেনেন না জানেন না তার বংশ বা পড়াশোনা কোন কিছুই আপনার অবগত ন। তবুও মানুষটির সাথে দুই মিনিট কথা বলার পরেই তার সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারনা আপনি করে ফেলতে পারেন। পরবর্তীতে তার সাথে আপনার আচরণ কেমন হবে তার একটা পরিকল্পনা আপনা-আপনি আপনার মাথার মাঝে তৈরি হয়ে যায়। বলতে পারেন কি এর কারণ কি? এর কারণ হলো তার কথা বলার ধরণ এবং অভিব্যক্তি। একজন মানুষকে রিপ্রেজেন্ট করে তার কথা বলার ধরণ। বাহ্যিক সৌন্দর্যের অন্যতম একটি উপাদান হচ্ছে সুন্দর করে কথা বলা। আপনার ব্যক্তিত্বের একটি বড় অংশ হল কথা বলার ধরণ।হয়তো আপনি দেখতে সুন্দর না, হয়তো আপনার অনেক সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, হয়তো আপনি শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ না, এসব কিছুকে ছাপিয়ে আপনাকে সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসতে পারে শুধুমাত্র আপনার সুন্দর করে কথা বলা। সুন্দর করে কথা বলতে পারার সবচেয়ে পজেটিভ দিকগুলো হলো:
১। আত্মবিশ্বাসী থাকা যায়, ২। উদ্যমী হওয়া যায়, ৩। অন্যর চোখে ভাল ইম্প্রেশন তৈরি করা যায়, ৪।মানুষকে সহজে কনভিন্স করা যায়। আপনি যদি একজন সফল মানুষ হতে চান সবার আগেই এই সবকটি গুণ আপনার মধ্যে থাকাটা জরুরি।
এবার একটু দেখি সুন্দর করে কথা না বলতে পারলে কি হয়? বিশাল বড় তালিকার মাত্র কয়েকটি তুলে ধরছি:
১। প্রথমেই আপনাকে সবাই ভুল বুঝবে, ২। আপনার হতাশা তৈরি হবে, ৩। মানসিক অশান্তি সৃষ্টি হবে, ৪। ব্যর্থতার বৃত্তে ঘূর্ণি খেতে থাকবেন। সুন্দর করে কথা বলাটা যে খুব বেশি কঠিন তা কিন্তু নয়। এর জন্য একটু সচেতন হওয়া এবং কিছুদিন অন্তত নিজের কথা বলার একটা ফিল্টার বসিয়ে চর্চা করা। কোন কথাটা আপনি বলবেন আর কোন কথাটা বলবেন না। একবার ভেবে দেখুন যে, এক সুন্দর করে কথা বলা যদি আপনাকে এতগুলো সুবিধা দিতে পারে আপনি কি তার জন্য সামান্য একটু কষ্ট করতে পারবেন না? তাহলে আসুন কিভাবে সুন্দর করে কথা বলতে হয় তার কিছু টিপস এখনই আমরা জেনে নেই:
১। প্রথমে আপনাকে হাসিমুখে কথা বলতে হবে। বলুনতো পৃথিবীর যেকোন মানুষকে সবচেয়ে সুন্দর লাগে কখন? হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন যখন সে হাসে। এবার ভাবুন তো কোন দোকানে যেতে আপনার ভালো লাগে? যে সব সময় হাসিমুখে আন্তরিকতার সাথে কথা বলে? নাকি যে সবসময় গুমোট হয়ে মুখ অন্ধকার করে বসে থাকে? অথবা চোখ বন্ধ করে একবার ভাবুন তো কোন মানুষটাকে আপনার ভালো লাগে? দেখবেন হাসিমুখে থাকা মানুষগুলোই আপনার ভালো লাগার জায়গা দখল করে আছে। তাই সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত এই অসম্ভব গুনটিকে ব্যবহার করুন।
২। ইতিবাচক কথা বলুন। দৈনন্দিন কথার মাঝে কখনোই কোনো নেতিবাচক ব্যবহার না। কারণ নেতিবাচক হতাশা সৃষ্টি করে এবং শূন্যতা তৈরি করে। একবার এক ম্যারেজ কাউন্সিলের কাছে এক দম্পত্তি গিয়েছিলেন পারিবারিক সমস্যা। ম্যারেজ কাউন্সিলর তাদের সাথে কথা বলে জানালেন প্রতিদিন মহিলা তার স্বামীকে বাজার প্রসঙ্গে বলেন: চাল নেই, চিনি নেই, সবজি নেই, মাছ নেই এই নাই নাই শব্দ শুনতে শুনতে ভদ্রলোক একটি সুন্নত অনুভব করেন। তখন ম্যারেজ কাউন্সিলর পরামর্শ দিলেন এখন থেকে কথা বলতে একটু ঘুরিয়ে বলতে। নাই এর জায়গায় বলবেন লাগবে। কিন্তু এই কথাগুলো যদি মহিলাটা এভাবে বলতেন: চাল লাগবে, চিনি লাগবে, সবজি লাগবে তাহলে সংসারে অশান্তি অনেক কমে যেত। কারণ নেই শব্দটির থেকে লাগবে শব্দটি ইতিবাচক এবং এটি ভালো অনুরণন সৃষ্টি করে। নেতিবাচক কথা বা শব্দগুলোর ইতিবাচক শব্দ খুঁজে বের করুন এবং নিয়মিত ইতিবাচক অভিব্যক্তির চর্চা করুন।
৩। বিতর্ক পরিহার করুন। বিতর্ক মানেই আরেক পক্ষকে হেয় করা। হেয় বা অসম্মান করে আসলে কখনো কারো হৃদয়কে জয় করা যায় না। বুদ্ধিমান মানুষ কখনো বিতর্কে লিপ্ত হয় না বরং তারা বুদ্ধিকে ব্যবহার করে বিতর্ক এড়ানোর জন্য। একটু রাগ না দেখালে আমরা মনে করি কেউ পাত্তা দেবে না। অথবা অহেতুক চিৎকার-চেঁচামেচি না করলে আমার দাম কমে যাবে। ইতিহাস কিন্তু উল্টোটাই সাক্ষ্য দেয়। তাই বিতর্ক সবসময় এড়িয়ে চলবেন।
৪। বিদ্রূপের জবার দিন বিনয়ের সাথে। রবীন্দ্রনাথ তার গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য নোবেল পুরুষ্কার পান ১৯১৩ সালে। পশ্চিমাদের অনেকেরই এটা সহ্য হচ্ছিল না। একবার এক পশ্চিমা সাহেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বলেই বসলেন গীতাঞ্জলি বইটি দারুন হয়েছে, কে আসলে ওটা লিখে দিয়েছিল তোমায় হয়ে? সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এলো কবিগুরুর বুদ্ধি দিপ্ত উত্তর। তার আগে বলো দেখি কে আসলে তোমাকে পড়িয়ে দিয়েছিল গীতঞ্জলির মত কাব্য? একবার নিজেকে কবিগুরুর স্থানে বসিয়ে দেখুন তো আপনি কি উত্তর দিতেন? তাই নিজের বুদ্ধিতে ব্যবহার করুন বিদ্রূপকারীর সাথে তর্কে লিপ্ত হওয়ার পরিবর্তে বিদ্রুপের বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর দিতে।
৫। স্থান-কাল পাত্র বিবেচনা করে কথা বলুন। জর্জ বার্নার্ড শ একবার আমেরিকায় লেকচার প্রধানকালে শ্রোতাদের উদ্দেশ্য করে বললেন: ’৫০% আমেরিকান ইডিয়েট’ বলতেই সভাস্থলে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেলো। এটা লক্ষ্য করে বার্নার্ড শ বললেন ৫০% আমেরিকানার জ্ঞানী। অর্থাৎ ৫০ শাতাংশ আমেরিকান হচ্ছে বিজ্ঞব্যক্তি বলতেই সভাস্থলে গুঞ্জন কমে গেল। তাই কি বলছে কাকে বলছেন কথা বলার সময় সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
৬। বলুন কম, শুনুন বেশি। স্রষ্টা মানুষকে দুটু কান দিয়েছেন এবং একটি মুখ দিয়েছেন। অতএব শুনতে হবে বেশি এবং বলতে হবে কম। তাই বলার আগে সচেতন হোন কখন কাকে কি বলে ফেলছেন? কথা বলার চেয়ে সোনার প্রতি বেশি মনোযোগী হন। কারণ ভালো বক্তার চেয়ে ভালো শ্রোতা অন্যকে বেশি আকৃষ্ট করে। মনে রাখবেন জ্ঞানী কথা বলেন প্রজ্ঞাবান শোনেন।
৭। শব্দভান্ডার বাড়ান। হোক বাংলা কিংবা ইংরেজি সব ভাষার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত শব্দ জানা আবশ্যক। এতে করে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না যে, এই শব্দের পর আপনি অন্য কোন শব্দ ব্যবহার করবেন? আমরা দৈনন্দিন জীবনে যেসব শব্দ ব্যবহার করি, বাংলা অভিধান খুলে তার সমার্থক শব্দ গুলো দেখে নিতে পারেন। অথবা এমন অনেক শব্দ খুঁজে নিতে পারেন, যেগুলো সাধারণত কথায় আমরা খুব কমই ব্যবহার করি এবং তা প্রয়োগ করুন উপযুক্ত ক্ষেত্র বুঝে। এতে আপনার কথা যেমন সুন্দর হবে, তেমনি শ্রোতার মনে আপনার জ্ঞান সম্পর্কে ভালো ধারণা জন্মাবে।
৮। অঙ্গভঙ্গি: আপনার কথার মূল্য অনেকটা বাড়িয়ে দিবে সঠিক বডি ল্যাঙ্গুয়েজ। আপনার এক্সপ্রেস দাড়ানো বা বসার ভঙ্গি হাত নাড়ানো এসব দিকেৎ মনোযোগ দিন। কোন কিছুই অতিরিক্ত করার ধরকার নেই। তবে কথার সাথে যেন অঙ্গভঙ্গি খাপ খায় সেই চেষ্টা করুন। অনেকের অভ্যাস সাথে কথা বলার সময় কাঁধে হাত দেয়া বা বাবার গায়ে খোঁচা দিয়ে নিজের দিকে মনোযোগ ফেরানোর। আপনার যদি এমন কোনো অভ্যাস থেকে থাকে দয়া করে এখনই পরিহার করুন। কারন আপনার বডি ল্যাঙ্গুয়েজই প্রমান করবে আপনার আত্মবিশ্বাস।
৯। শুনুন এবং বুঝুন: শুধুমাত্র আপনিই সব হড়বড় করে বলে যাবেন এটা কিন্তু স্মার্টনেসের মধ্যে পড়ে না। বরং আপনি যার সাথে কথা বলছেন তার প্রত্যেকটা কথা শোনা এবং বোঝাও স্মার্টনেসের অন্তর্ভুক্ত। কেউ আপনার সাথে কথা বলার সময় তাকান সরাসরি তার দিকে, তার চোখের দিকে, কোন কথা বুঝতে সমস্যা হলে তার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করুন সে কি বলছে? এটা কে বলা হয় “লিপ রিডিং” যেটা খুব কম শ্রবণ শক্তির অধিকারী মানুষজন প্রয়োগ করে থাকেন। তার কথায় সম্মতি জানান, মাথা বা হাত নেড়ে তাকে বোঝান যে, আপনি তার কথা মন দিয়ে শুনছেন এবং কারো কথা শোনার সময় মন দিয়ে শুনুন এবং তার প্রশ্ন বোঝার চেষ্টা করুন। কারণ প্রশ্ন ঠিকভাবে বুঝলেই কেবল আপনি ঠিক ভাবে উত্তরটা দিতে পারবেন। এতে অনেক ভুল বোঝাবুঝিও কমে যাবে।
১০। অনুকরণ ও অনুসরণ: অনুসরণ করুন রেডিও বা টিভির সংবাদ উপস্থাপকদের। বিভিন্ন সফল ব্যক্তির কথা বলার ধরণ এবং অঙ্গভঙ্গী লক্ষ্য করুন। অথবা নিজের কোন প্রিয় অভিনেতাকে অথবা কোন প্রিয় ব্যক্তিত্ব কে। যাকে আপনি পছন্দ করেন, যার কথা বলার ধরণ আপনাকে আকর্ষণ করে এবং যাকে দেখে আপনার মনে হয় যে, আপনি তার মত কথা বলতে পারবেন।
তাহলে আজ থেকেই শুরু করে দিন সুন্দর করে কথা বলার চর্চা। খুব অল্প সময়ে আপনি লক্ষ্য করবেন আপনি আগের চেয়ে অনেক স্মার্টলি কথা বলতে পারছেন এবং ধীরে ধীরে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছেন। শেয়ার করে অন্যদের জানার সুযোগ করে দিন। অসংখ্য ধন্যবাদ মন দিয়ে পড়ারজন্য।